একটা সময় ছিলো হাঁসি-খুশির, বাবার হাত ধরে পথ চলতে শেখা, বাবার হাত ধরেই বাড়ির আশেপাশের পরিবেশ মানুষজনের সাথে পরিচয় হওয়া, ধীরে ধীরে মা বাবার সাথে বড়ো হয়ে ওঠা। সংসার একমাত্র বাবার হাত ধরেই বেড়ে উঠছিল। স্বাচ্ছন্দ্যে চলছিল তাদের সংসার, কিন্তু হঠাৎ এক দমকা হাওয়ায় একদিন দিন ছন্দ পতন দেখা দিল। মাথার উপর থেকে ছাদ হারিয়ে গেল। পিতৃ বিয়োগে নিঃস্ব হয়ে পড়ল সংসার। এটা কোন রুপকথার গল্প নয়, এটা পাত্রসায়রের কর্মকার পরিবারের বাস্তব চিত্র।
পাত্রসায়ের এর চায়না কর্মকার, বয়স ২৭ বছর। নিজে সাইকেলের দোকান চালিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। বাবা মোহন কর্মকার বছর ছয় আগেই মারা গিয়েছেন। তারপর থেকেই সংসারের হাল ধরেছেন তার মেজো মেয়ে চায়না কর্মকার। এই মুহূর্তে সংসারের একমাত্র রোজগেরে চায়না। এছাড়াও ঘাড়ের উপর রয়েছে বয়স্ক মা ও বোন রিনা কর্মকার এবং মিরা কর্মকার বয়স ২২ বছর ও মেঘা কর্মকার বয়স ১৯ বছর। চায়না কর্মকার নিজে সেকেণ্ড ইয়ার পর্যন্ত পড়াশুনা করে আর করতে পারেনি। কিন্তু দুই বোনের যাতে পড়াশুনায় কোন ক্ষতি না হয় তারজন্য করতে হচ্ছে কঠোর পরিশ্রম। বোন মিরা কর্মকার এ এন এম নার্সিং ট্রেণিং শেষ করেছে এবং বোন মেঘা কর্মকার সেও নার্সিং ট্রেণিং করছে।
তাই একদিকে বুড়ো মা অন্যদিকে দুই বোনের পড়াশুনার খরচ দুই জোগাড় করতে ঘাম ছুটে যাচ্ছে চায়না কর্মকারের। একবিংশ শতাব্দীতে যখন অন্য মেয়েরা পড়াশোনা আর নিজের প্রিয়জনদের সাথে সুখের সময় কাটাতে ব্যাস্ত অন্যদিকে একজন মেয়ে হয়ে যে ভাবে সংসারের হাল ধরেছে চায়না সত্যি তা নারী জাতির সন্মান। তবে বাস্তব সত্য এই যে যেখানে নিজে বিয়ে করে সংসার করবে আজ সেখানে তাকেই পরিবারের হাল ধরতে হচ্ছে। নিজে পড়াশুনা করে আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো সরকারি চাকরি করার ইচ্ছা থাকলেও আজ বাস্তব তাকে অন্য জায়গায় এনে দাড় করিয়েছে।
তবে এত কষ্টের মধ্যে সংসার চললেও সরকার থেকে এখনও কোন সাহায্য মেলেনি। মাটির দেওয়াল আর উপরে অ্যাসবেস্টরের ঘড়ে কোনরকমে রাত কাটাতে হচ্ছে এই পরিবারটিকে।
চায়না কর্মকার আমাদের ক্যামেরার সামনে জানান, বাবার কাছ থেকেই আমার এই কাজের হাতেখড়ি। তারপর বাবা মারা যাবার পর থেকে সংসারের হাল ধরতে এবং বৃদ্ধা মা এবং দুই বোনের পড়াশুনার খরচ চালাতে আমাকেই দোকান চালাতে হয়। তবে এতো সবের পরেও কোন রকমে সংসার চলছে বলে জানায় সে।
বোন মেঘা কর্মকার জানায়, দিদির জন্য আমাদের গর্ব হয় কিন্ত বাজারে এত লোকের মাঝে দিদিকে কাজ করতে হয় এই ভেবে কিছুটা খারপও লাগে। তবে আগামী দিনে দিদির জন্য কিছু করার ইচ্ছা রয়েছে মেঘার।
চায়না কর্মকারের মা রিনা কর্মকার আমাদের ক্যামেরার সামনে চোখের জল ধরে রাখতে না পেরে কেঁদেই ফেললেন। তিনি অশ্রু সজল কান্নাভারাক্রান্ত গলায় বলেন, আমার মেয়ে সিআরপিএফের চাকরি হয়েও হলো না। তাই সংসার চালাতে মেয়ে হয়েও ওকে সাইকেলের কাজ করতে হচ্ছে।
চায়নার প্রতিবেশী ব্যাবসায়ী চিওরঞ্জন কর্মকার বলেন চায়না শিক্ষিত মেয়ে চাকরির চেষ্টা করলেও হয়নি। তাই ওর যাতে একটা সরকারি কাজ হয় তাহলে খুব ভালো হয়।
চায়নার এই কর্মের মাধ্যমে তার পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াইকে স্যালুট জানিয়েছে সাধারণ মানুষ। এই পরিস্থিতিতে চায়নার পাশে দাঁড়াবে কি সরকার ?দারিদ্রতা উপেক্ষা করে বোনদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে পরিবারের মুখে হাঁসি ফোটাতে পারবে চায়না! সেটা তো ভবিষ্যত বলবে।